চিকিৎসা পরিষেবার মান ও রোগী কেন্দ্রিক চিকিৎসা

চিকিৎসা পরিষেবার মান ও রোগী কেন্দ্রিক চিকিৎসা

আমার ঝলসে যাওয়া হাতের চিকিৎসা

একবার যোগব্যায়াম করতে গিয়ে খুব সম্ভবত ঘাড়ে আঘাত পেয়েছিলাম। তার পরের দিন পিঠের ডান দিকে যন্ত্রণা হচ্ছিল, ডানহাতের বুড়ো আঙুলে সাড় ছিল না, হাত দুর্বল; এই অবস্থায়, ভাবলাম কাঁধে গরম জলের ব্যাগ দিয়ে রাখলে আরাম হবে, তাই জল ফুটিয়ে ব্যাগে যেই পুরতে গেছি, ফুটন্ত জল চলকে ডান হাতেই পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে হাতের চামড়া ঝলসে গেল । সেই ঝলসানো চামড়ার ড্রেসিং করতে একটি ক্লিনিকে গেলাম। যে নার্স দিদি আমার চিকিৎসা করলেন, তিনি ড্রেসিং করার সময় গম্ভীর থমথমে মুখে কাজ করে গেলেন, আমার সঙ্গে একটি কথাও বললেন না। আমি যে তাঁর সামনে একজন জলজ্যান্ত মানুষ বসে আছি, মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠছি, আমাকে আমল দেওয়া দূরের কথা, আমার যন্ত্রণা হচ্ছে কি না, একবার দুবার জিজ্ঞেস করলেন কি করলেন না, কোন কিছুরই তোয়াক্কা না করে, খস খস করে কাঁচি দিয়ে, এমন ভাবে পোড়া চামড়া কেটে দগদগে কাটা ঘায়ের ওপর মলম আর পটি দিয়ে ড্রেসিং করলেন হাতটা যেন শরীর বহির্ভূত, পরিপাটি করে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিলেন, তারপর আমাকে রীতিমতন শাসনের সুরে বললেন, যে এই ভাল করে ড্রেসিং করে দিলাম, বলে বললেন, যান, বাইরে বসে একটু জিরিয়ে নিয়ে বাড়ি চলে যান। দেখবেন যেন একটুও জল লাগাবেন না, সাত দিনে সেরে যাবে। হাতের ঘা সেরে গেল, কিন্তু সেদিনের সেই সাংঘাতিক নৈর্বক্তিক নিদান, তার পর দিনের পর দিন ব্যাণ্ডেজ করা হাতের ভেতরের যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে আমি অহরহ নিজেকে প্রশ্ন করেছি, এই যে চিকিৎসা পেলাম, এ চিকিৎসা ভাল না মন্দ? আমি নিজে একজন চিকিৎসক। আমি নিজেই কি এ ধরণের চিকিৎসা করিনি কখনো? তাই বুঝি যেমন কর্ম তেমন ফল? আপন কর্মফলের বিচার করতে গিয়ে ভেবেছি, রোগীর, চিকিৎসকের, সকলের চোখে চিকিৎসার ভাল মন্দ এই নিয়ে বিচার বিবেচনা করলে কি কি দেখা উচিৎ, কার চোখে দেখা উচিৎ। যাই বলি না কেন, এ কথা স্বীকার করতেই হয় যে আমার চিকিৎসা যিনি করেছেন তিনি একজন অতীব অভিজ্ঞ ও দক্ষ নার্স, তাঁর চিকিৎসার হাত ও পেশাগত নৈপুণ্য প্রশ্নাতীত, ক্লিনিকটি যৎপরোনাস্তি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, তাতে প্রায় যত রকমের ব্যবস্থা থাকা প্রত্যাশিত সব ছিল, আমার চিকিৎসার খরচ খুবই সামান্য, এবং আমি যথাসময়ে পুরোপুরি ভাল হয়েও গেছি । তবুও রোগীর চোখ দিয়ে বিচার করতে গিয়ে আমি কেন একে সর্বতোভাবে ভাল চিকিৎসা বলতে দ্বিধাবোধ করি? কি হলে বলতাম সে চিকিৎসা সর্বোচ্চ মান স্পর্শ করেছে, কি হলে বলতাম যথাযথ ভাবে ভাল চিকিৎসা পেয়েছি? কাকে বলে ভাল চিকিৎসা? কিভাবে ভাল চিকিৎসা-প্রতিষ্ঠান চিনব? কিভাবে ভাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করব? কিভাবে চিকিৎসার মান নিরূপণ করব? সেই আলোচনাই এই লেখার উদ্দেশ্য। রোগীর, চিকিৎসকের, নার্সের, অন্যান্য স্বাস্থ্য পরিষেবা যাঁরা দেন, তাঁদের, এমনকি সরকারের পরিপ্রেক্ষিতেও, আমাদের সকলেরই চিকিৎসা-ব্যবস্থার ভাল মন্দকে খুঁটিয়ে দেখার একটা প্রয়োজন আছে। নিখুঁত কারিগররের হাতে সংবেদনহীন, নৈর্বক্তিক, ও আন্তরিকতাহীন চিকিৎসা আমাদের অনেককেই সহ্য করতে হয়। আমরা রুগীরা প্রচুর সময ও অর্থ ব্যয় করি; তা সত্ত্বেও অসহায়ভাবে চিকিৎসা পাই। খাতায় কলমে প্রযুক্তিগত দিক থেকে যে সব চিকিৎসা সাংঘাতিক জটিল, যে সব জায়গায় সে ধরণের চিকিৎসার বন্দোবস্ত আছে, তাকে সুপার-স্পেশালিটি হাসপাতাল বলি আমরা, চিকিৎসার নানান স্তরের কথা সরকারী স্বাস্থ্য দপ্তর আমাদের জানান, বলেন ত্রিস্তরীয় পরিকাঠামোয় চিকিৎসার কথা। সরকারী কি বেসরকারী, যার যত উচ্চস্তর তত সে উন্নত বলে ধরে নিই, তত সে চিকিৎসা মানী, ও তত সে দামী। এখন প্রশ্ন, আপনি জানবেন কিভাবে সত্যি সে চিকিৎসা-ব্যবস্থার মান ভাল কি না? প্রশ্নটা ফেলনা নয়, কারণ না জানলে বা না বিচার করতে শিখলে প্রাণসংশয় অবধি হতে পারে। কোন চিকিৎসা-ব্যবস্থার মান ভাল, কোনটির মান আরো ভালো, এ বিষয়টি জটিল। আমরা রুগীরা বা তাঁদের বাড়ির লোকেরা কোন বিশেষ একটি স্বাস্থ্য-সংস্থা, কোন রাজ্যের চিকিৎসা-ব্যবস্থা, কি কোন হাসপাতালকে হয়ত ওপর থেকে দেখে ভাবছি খুব ভাল, আসলে রোগী নিয়ে সেখানে ভর্তি হতে বা চিকিৎসা পেতে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হয়, এমনকি ভুল চিকিৎসা হতে পারে, অর্থদণ্ডের কথা তো ছেড়েই দিলাম । আবার অন্যদিকে যে প্রতিষ্ঠানটিকে মনে মনে খারাপ ভাবছি, হয়ত সেখানে কম পয়সায় চিকিৎসা হয়, সে হয়ত বহিরঙ্গে তাকে দেখতে মামুলি, তাই তাকে প্রত্যাখ্যান করলাম, অথচ সেখানেই চিকিৎসা করাতে গেলে দেখতাম তারা অতি আন্তরিক ও ভাল চিকিৎসা করে। আর কিছু না হোক, অনাবশ্যক অর্থদণ্ডের হাত থেকে রেহাই পেতাম। চিকিৎসকের তরফে দেখা যাক। আজকাল ভারতে হাসপাতালের ডাক্তারদের, বা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন, এমন ডাক্তারদের, রোগীর বাড়ির লোকেরা বা জনসাধারণ গায়ে হাত তুলতে শোনা যায়, সম্মানহানি হয়, এ ধরণের মর্মান্তিক ও দুঃখজনক সংবাদ প্রায়ই শোনা যায় । বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় ডাক্তারবাবুর চিকিৎসা নির্ভুল, তবুও তাঁকে অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে । ডাক্তার ভাবছেন তিনি তাঁর জ্ঞানবুদ্ধিঅভিজ্ঞতা-প্রসূত, সাধ্যমত চিকিৎসা করেছেন, অভিজ্ঞতা ও প্রমাণের ভিত্তিতে যা চিকিৎসা করা হল, উন্নত মানের চিকিৎসা বিচার করতে গেলে এইটুকুই যথেষ্ট, ডাক্তারের পক্ষে চিকিৎসা কতটা খরচসাপেক্ষ বা রোগী-চিকিৎসাকারী দলের পারস্পরিক সম্পর্ক বা রোগীদের রোগ নিয়ে অবহিত করা, তাদের সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলার ব্যাপারটি তাঁর চিকিৎসক সত্তায় বিচার করলে গৌণ। চিকিৎসার জটিল দিক, কেবল কারিগরি দিকটি তিনি ভাল বোঝেন । অথচ চিকিৎসা ত্রুটিহীন হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে রোগীপক্ষের অসন্তোষের শিকার হতে হল, এমনও হতে পারে চিকিৎসাকারী দলের অন্যান্য সদস্য বা অন্যান্যরা রোগীর পরিবার বা রোগীর সঙ্গে অশিষ্ট আচরণ করলেন, এতে রোগীর বাড়ির লোক অসন্তুষ্ট হলেন, ফলে চিকিৎসার যাবতীয় দায়, রোগী ও তাঁর বাড়ির লোকের রোষ, বেচারা ডাক্তারের ঘাড়ে পড়ল । দেখা যাচ্ছে, ডাক্তারবাবুর দিক থেকে চিকিৎসার গুণমান শুধু রোগমুক্তি বা যথাযথ চিকিৎসা দিয়ে বিচার বিবেচনা করলে যথেষ্ট হবে না, নেহাত প্রাণ বাঁচানোর তাগিদেও আমরা যারা রুগী কি ডাক্তার, যাঁরা চিকিৎসা পরিষেবার গুণমান বিচার করতে চাই, আরো কিছু বিষয় ভেবে দেখতে হবে। চিকিৎসা কি স্বাস্থ্যের মান নিরূপণের ক্ষেত্রে আমরা প্রায়ই সরকারী, বেসরকারী, আন্তর্জাতিক, নানারকম পরিসংখ্যানের সাহায্য নিই। পাঁচ বছর বয়সের কম বয়সী শিশু মৃত্যু, বা চিকিৎসক-পিছু কত শয্যা, সেই সংখ্যার নিরিখে গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থার সামগ্রিক মান নিরূপণের একটা আবছা ছবি আমরা পাই বটে, তাতে কি সবটা বোঝা যায়? আসলে রাজ্যটিতে বা যে জায়গাটির চিকিৎসার আলোচনা হচ্ছে, সেখানে সত্যিকারের চিকিৎসার বা স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থার মান কতটা ভাল, তার ছবিটা অস্পষ্টই থেকে যায়, কারণ গোটা ব্যাপারের পরিসংখ্যান থেকে ব্যক্তির ক্ষেত্রে কি বা কতটা প্রযোজ্য তা নির্ণয় করা অসম্ভব।

অ্যাভেডিস ডোনাবেডিয়ান ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মান নির্ণয়ের বিজ্ঞান

১৯৬৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর্মেনীয় চিকিৎসক অ্যাভেদিস ডোনাবেডিয়ান চিকিৎসা-ব্যবস্থার গুণমান নির্ণয় করার তত্ত্ব নিয়ে লেখালিখি শুরু করেন, ও ২০০৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রায় চার দশক ধরে এ নিয়ে গবেষণা করেন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার স্বাস্থ্য ও মান নিরূপণ, প্রথা, প্রণালী, পরিমাপ করার কাজের পেছনে এঁর অবদান অনন্য। ডোনাবেডিয়ানের মত অনুযায়ী চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে কয়েকটি বিষয় ভেবে দেখতে হবে। স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে - রুগী কিভাবে চিকিৎসা পরিষেবার নাগাল পান; স্বাস্থ্য কি চিকিৎসা পরিষেবাতে কতটা অর্থ ও সময় ব্যয় হয়, ও চিকিৎসা পরিষেবার কেমন গুণমান। এই তিনটি বিষয় একে অপরের পরিপুরক। এর মধ্যে খরচের ব্যাপারটি শুধু অর্থের মাপে দেখলে চলবে না। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক: ধরুন একজন মানুষ গ্রামে থাকেন; তিনি শহরে সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে ডাক্তার দেখাবেন। তাঁকে গ্রাম থেকে খুব সকালে বেরিয়ে ট্রেন ধরে শহরে আসতে হবে; আউটডোরে ডাক্তার দেখানোর খরচা হয়ত তাঁর বেশী পড়ল না, কিন্তু তাতে তাঁর অনেকটা সময় চলে গেল, তার ওপর সারা সকাল অপেক্ষা করার পর ডাক্তার বাবুর সঙ্গে তাঁর হয়ত বড়জোর পাঁচ কি দশ মিনিটের সাক্ষাৎ হল। এখানে তাঁর খরচ শুধু অর্থের মাপে দেখলে চলবে না, কতটা সময় তিনি ব্যয় করলেন ও তার বিনিময়ে কি ধরণের পরিষেবা তিনি পেলেন, তাও বিচার করে দেখতে হবে। আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। একজন রুগীর প্লাস্টিক সার্জারী করতে হবে, ডাক্তারবাবু তাঁকে ১ লাখ টাকার বিল ধরালেন। এখানে আবার সময় ও অর্থ, দুটিই বিবেচনা করে দেখতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার তৃতীয় শর্ত, বিশেষ করে যে বিষয়টি নিয়ে এই লেখা, সেটি হল, চিকিৎসা পরিষেবার গুণমান । চিকিৎসার মান নির্ণয় করতে গেলে আরো তিনটি বিষয়, বিবেচনা করে দেখতে হবে: পরিকাঠামো, প্রণালী, ও ফলাফল। আবার এই তিনটি ব্যাপারকে দেখতে হবে কে কিরকম ভাবে স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত তাঁর দৃষ্টিতে -- এঁরা তিনটি শরিক -- ডাক্তার বা যিনি স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান করেন (প্রদায়ী), রুগী (উপভোক্তা), ও অর্থদাতা । এঁদের তিনজনের তিন রকম পরিপ্রেক্ষিত, তাই নানান রকমের প্রত্যাশা।

স্বাস্থ্যব্যবস্থার তিন শরিক

চিকিৎসা পরিষেবার কেন্দ্রবিন্দুতে রুগীর অবস্থান। তাঁকে বা তাঁর প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে চিকিৎসার মান নির্ণয় করতে হবে। আমরা সকলেই জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে রোগীর ভূমিকা গ্রহণ করি বা করতে হয়, কাজেই চিকিৎসা-ব্যবস্থার গুণমান নির্ণয় করতে গিয়ে এই উপভোক্তা শ্রেণী, বা রোগীর পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখার একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। আবার রোগী আছেন বলেই চিকিৎসকও আছেন। এখানে চিকিৎসক অর্থে কেবল ডাক্তার নন, যাঁরা চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান করছেন তাঁরা সবাই এর আওতায় পড়বেন, এঁরা চিকিৎসা নামক সেবাটির পরিষেবক। এঁদের মধ্যে ডাক্তার যেমন আছেন, তেমন আছেন নার্স , ফিজিওথেরাপিস্ট, প্রমুখ সকলে যাঁরা কোন না কোন ভাবে আমাদের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান করেন। চিকিৎসা পরিষেবায় রুগী ও ডাক্তারবাবুর অবস্থান পরস্পরের বিপরীত মেরুতে, গ্রহীতা ও দাতার ভূমিকায়। একজন চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান করবেন, অন্যজন তাকে গ্রহণ করবেন। এঁদের বাইরে আছেন যাঁরা স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিষেবাকে অর্থযোগান দিয়ে চালু রাখেন। এঁদের মধ্যে ভারতের মতন দেশে সরকারের ভূমিকাই সবচেয়ে আগে বিবেচনা করতে হবে, কারণ সমাজব্যবস্থায় সরকার দেশের চিকিৎসা পরিষেবার বেশ বড় একটা অংশ সরকারী অনুদান ও সরকারের বাজেট থেকে অর্থের ওপর নির্ভরশীল। জাতীয় ও রাজ্যসরকার আমাদের দেশে সরকারী চিকিৎসালয়ের যাবতীয় দায়ভার বহন করেন। এছাড়াও সরকারী-বেসরকারী পার্টনারশিপে যে সমস্ত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান চলে তাদের ক্ষেত্রেও স্বাস্থ্য দপ্তরের অবদান রয়েছে। ভারতে রেল ও, সামরিক প্রতিষ্ঠানের হাসপাতালে যে চিকিৎসা হয় তার খরচও সরকারের। বেসরকারী ক্ষেত্রে চিকিৎসার খরচ যোগান হয় রুগী বা তাঁর পরিবাররা, তা না হলে যাঁদের বীমা করা আছে, সেক্ষেত্রে বীমা কোম্পানীগুলো। স্বাস্থ্য-চিকিৎসা-পরিষেবার মান ও উৎকর্ষতা নিয়ে এই তিন শরিকের আগ্রহ একেক রকম। রুগী বা তাঁর বাড়ির লোকের ক্ষেত্রে রোগমুক্তিই প্রথম লক্ষ্য, যত কম সময়ে যত দ্রুত সু্স্থ হয়ে ওঠা যায়, যত কম অন্যান্য অসুবিধে হয়, রুগীর পক্ষে ততই মঙ্গলকর। তাই রুগীর বা তাঁর বাড়ির লোকের পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসার মান নির্ধারণ করতে হবে রোগ নিরাময় ও পরিষেবাকে কেন্দ্র করে। এতে আবার যখন সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসা পরিষেবার মান নির্ণয় করতে হবে, তখন কতটা খরচ হচ্ছে সেটি এখানে তাঁদের নজরে মুখ্য নয়। আবার যখন বেসরকারী চিকিৎসা পরিষেবার গুণমান নির্ণয় করতে হবে, রুগীর পরিপ্রেক্ষিতে, বিশেষ করে যাঁরা নিজের চিকিৎসার ব্যয়ভার নিজেরা বহন করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে শুধু রোগমুক্তি বা ভাল হয়ে ওঠা দেখলে চলবে না, কত কম সময় ও কত কম অর্থ ব্যয় হয়, সেটিও বিচার করে দেখতে হবে। যত কম খরচায় যত ভাল পরিষেবা পাওয়া যায়, তত মঙ্গল, তাই চিকিৎসার ফলাফলের দিকে রুগীর নজর প্রথমে, তার পরে চিকিৎসার ব্যয়সংক্রান্ত বিষয়গুলি বিচার্য। চিকিৎসকের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে চিকিৎসা পরিষেবার মান হয়ত নির্ধারিত হবে কত দ্রুত রুগী ভাল হয়ে গেলেন, বা কতটা প্রমাণনির্ভর চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করে চিকিৎসা করা হয়েছে -- সেখানে কতটা সাশ্রয়ী চিকিৎসা হল, সেটা সবসময়ে বড় কথা নয়। এবং বহু চিকিৎসকের কাছ, চিকিৎসার ব্যয়বাহুল্য বা রুগীর ইচ্ছে অনিচ্ছে অনুযায়ী চিকিৎসার রদবদল করার থেকেও রুগীর আরোগ্যলাভ করাটা বিশেষ করে উপসর্গের উপশম হওয়ার একটি আশু প্রয়োজন থাকে; তাই চিকিৎসকের পরিপ্রক্ষিতে চিকিৎসার মান নির্ধারণ কিছুটা রোগীর মতন হবে কত দ্রুত রুগী সুস্থ হয়ে উঠলেন, তবে কতটা কম অর্থব্যয় করে তাঁর চিকিৎসা করা গেল, অন্তত চিকিৎসা পরিষেবার মান নিরূপণে তা ততটা বিচার্য নাও হতে পারে। বাকী রইল যাঁরা চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করছেন বা চিকিৎসার খরচা বহন করছেন তাঁদের পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসা-পরিষেবার মান কি হবে? তাঁরা অবশ্যই বিচার করবেন যে সেই চিকিৎসাই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের যাতে কম খরচায় মানুষ দ্রুত সুস্থ হতে পারে। এখানে সময় ও অর্থ -- দুভাবেই কত কম খরচায় "কতটা স্বাস্থ্য পাওয়া" যায় সেই ব্যাপারটি বিবেচ্য।

স্বাস্থ্য পরিষেবার মান নির্ণয়ের তিনটি স্তম্ভ

এর পরিপ্রেক্ষিতে ডোনাবেডিয়ানের ভাষ্য অনুযায়ী, যেভাবেই দেখি না কেন, স্বাস্থ্য পরিষেবার মান নির্ধারণে তিনটি বিষয় বিবেচ্য: এক, পরিকাঠামো। পরিকাঠামো ছোট হতে পারে, যেমন কারো নিজস্ব প্রাইভেট প্র্যাকটিস, অথবা হতে পারে সরকারী স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার মত জটিল ও বৃহৎ। পরিকাঠামোর মধ্যে যে চিকিৎসা পাচ্ছেন বা করছেন তার উপযোগী যন্ত্রপাতি, মানুষজন, চিকিৎসক বা চিকিৎসা-কারী দলেন পেশাগত অভিজ্ঞতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা -- এই ধরণের যা যা কাঠামোগত বিষয় হতে পারে, এ সমস্ত বিবেচ্য। অতএব যখন চিকিৎসার গুণমান বিচার করবেন, ভেবে দেখুন, যে চিকিৎসক বা চিকিৎসক দল চিকিৎসা করছেন, তাঁদের যথাযথ ডিগ্রি কি অভিজ্ঞতা আছে তো? যে জায়গাটিতে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে তার কাঠামোটি কি যথাযথ? দুই, পরিষেবার প্রক্রিয়া। কি ভাবে পরিষেবা পাচ্ছেন বা কিভাবে, কি উপায়ে পরিষেবা প্রদান করা হচ্ছে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ও চিকিৎসা পরিষেবা হতে হবে প্রমাণ-ভিত্তিক, এর অর্থ চিকিৎসক যে ধরণের চিকিৎসা করবেন তার বৈজ্ঞানিক , গবেষণা-প্রসূত ভিত্তি থাকতে হবে, কেবল পুঁথিগত বা তত্ত্বগত দিক থেকে চিন্তাভাবনা করে চিকিৎসা করলেই চলবে না; চিকিৎসক কত বিখ্যাত, তাতে কিছু আসবে যাবে না। এর সমাজে পূর্ণ প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন প্রমাণ ভিত্তিক চিকিৎসার নির্দেশিকা, যে চিকিৎসা-ব্যবস্থা নিয়মিতভাবে তার সদব্যবহার করে, সে ব্যবস্থার মান অন্যদের তুলনায় উন্নত। তিন, চিকিৎসা পরিষেবার নিট ফলাফল। এর মধ্যে থাকবে স্বাস্থ্যের উন্নতি, রুগীর রোগ সম্বন্ধে ধারণা ও জ্ঞানলাভ, চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে রুগী ও তাঁর পরিবার কতটা সন্তুষ্ট হলেন, এই ধরণের মাপ। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে চিকিৎসা পরিষেবার মাণ অনেকটাই চিকিৎসার পরে কি ফল হল তার ওপর নির্ভর করে। যে রুগী অস্ত্রোপচার করে "ভাল" হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন, তিনি চিকিৎসা পরিষেবার মান কে কম নম্বর দেবার আগে দুবার ভাববেন। এখানে চিকিৎসা প্রক্রিয়ার ব্যাপারটি বিবেচনা করে দেখুন । ডোনাবেডিয়ানের মত অনুযায়ী চিকিৎসার প্রক্রিয়া ও ফলাফলের পারস্পরিক সম্বন্ধ জটিল। দেখা যায়, চিকিৎসা প্রক্রিয়া যথাযথ হল, তা সত্ত্বেও নানা কারণে রোগীর বিপর্যয় হতে পারে, ফল যা ডাক্তার বা চিকিৎসক দল আশা করেছিলেন, তার উলটো হল, আবার এও দেখা গেছে, চিকিৎসা প্রক্রিয়া হয়ত সম্পূর্ণ প্রমাণ ভিত্তিক চিকিৎসা বা নির্দেশিকা মেনে হল না, অথচ রুগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন, বা সুস্থ রইলেন। এর ওপর রোগের জটিলতা বা বাড়াবাড়ির বিষয়টি নিয়েও আলোচনার একটা জায়গা থেকে যায়। সরকারী হাসপাতালগুলোতে দেখবেন প্রায়শই জটিল ও নানারকম অন্যান্য রোগসম্বলিত রুগী ভর্তি হচ্ছেন, আবার ছোটখাট ও খুব নামীদামী বেসরকারী হাসপাতালে হয়ত খুব ভারী সংখ্যায় জটিল রোগীর ভর্তি সীমিত। কাজেই একই ফলের মাপকাঠিতে উভয় ধরণের চিকিৎসা-পরিষেবাকে বিচার করলে কেবলে ফলাফলের ভিত্তিতে দেখা যাবে যে বেসরকারী হাসপাতালের চিকিৎসা পরিষেবার মান সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসার মান থেকে অপেক্ষাকৃত উৎকৃষ্ট, আবার যেই রোগ-জটিলতা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গভীরে বিশ্লেষণ করে দেখলে দেখা যাবে আসলে এদের মান একই রকম। চিকিৎসার কি ফল হল তাই যদি চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য পরিষেবার একমাত্র মাপকাঠি হয়, তাহলে দুটো বিষয় গুলিয়ে যাবে। এক, কিভাবে পরিষেবা প্রদান করা হচ্ছে তার পর্যালোচনা করা অসম্ভব, কারণ ফলাফল-কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনায় প্রক্রিয়ার স্থান খুব সীমিত। দুই, প্রক্রিয়া কি পরিকাঠামোর কি প্রভাব, তাও অজানাই থেকে যাবে, একটা পরিমাপেই সব কিছুর সরলীকৃত হয়ে যায়। কি কি দেখা হয়? এক, কি ধরণের রোগ ধরা পড়ছে, কতজন মারা যাচ্ছেন, কতজন বেঁচে থাকছেন ও তাঁদের জীবনের মান কেমন। মৃত্যুহার ও জীবনের মান ("যেভাবে বেঁচে থাকা উচিৎ বা যেভাবে বেঁচে থাকলে বলতেন পূর্ণ মাত্রার জীবন ভোগ করছেন সেভাবে বেঁচে আছেন কি? সেটা না হলে পূর্ণ মাত্রার কত শতাংশ আয়ু?) বৃহত্তর বিষয়, গোটা সিস্টেমের মানের মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ডোনাবেডিয়ানের ভাষ্য অনুযায়ী পরিকাঠামো-প্রক্রিয়া-ফলাফল কেবল চিকিৎসার পরিষেবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, জনস্বাস্থ্যের মান বিচারের জন্য অন্য কিছু ভাবতে হবে।

মাণ নির্ণয়ের তিনটি পরিমাপ

পরিকাঠামো, প্রক্রিয়া, ফলাফল না হয় তিনটি বিচার্য বিষয়, প্রশ্ন ওঠে কিভাবে মাপবেন? চিকিৎসার উপযোগিতার তিনটি মাপকাঠি, আদর্শ চিকিৎসা। এমন চিকিৎসা যা কিনা বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় বিচার করে খুব সীমিত সংখ্যক রুগীর ওপরে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে সে চিকিৎসায় ফল হয় এবং সে চিকিৎসার কি কুফল। কিন্তু সব সময় তো আদর্শ চিকিৎসা সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে বাস্তবিক যে চিকিৎসা সম্ভব, তাতে রোগমুক্তির সম্ভাবনা কতটুকু, আর আদর্শ চিকিৎসার তুলনায় যে কতটা উপকারী, এরও পরিমাপ করতে হয়। একে ব্যবহারিক উপযোগিতা বলতে পারেন, পরিভাষায় বলা হয়। আদর্শ ও ব্যবহারিক, উভয় চিকিৎসাতেই অর্থব্যয় হয়। যে চিকিৎসার বেশী দামী, তার তুলনায় যে চিকিৎসায় অপেক্ষাকৃত স্বল্পমূল্যে একই ফল পাওয়া যায়, সে আরো সাশ্রয়ী। গুণমান বিচার করে সাশ্রয়ী চিকিৎসা অসাশ্রয়ী চিকিৎসার থেকে উচ্চতর গুণমানসম্পন্ন বলে বিবেচিত হবে। আভেদিস ডোনাবেডিয়ান লিখছেন, চিকিৎসক চিকিৎসার গ্যারান্টি দিতে পারেন না যে চিকিৎসায় রুগী ভাল হয়ে যাবেন। চিকিৎসক শুধু এইটুকু নিশ্চিত করতে পারেন যে তিনি তাঁর চিকিৎসা পরিষেবায় ক্রমান্বয়ে উন্নতি করবেন; চিকিৎসার একটি নির্দিষ্ট গুণমান তিনি অর্জন করবেন। এইটুকুই একজন চিকিৎসক বা চিকিৎসা-পরিষেবা যাঁরা দেন, তাঁরা নিশ্চিত করতে পারেন, এর বেশী নয় । একজন চিকিৎসকের তরফে এই গুণমান সুনিশ্চিত করা বা তার ক্রমাগত উন্নতির প্রতিশ্রুতি পালন কি ভাবে সম্ভব? এক, রুগী ও চিকিৎসকের পারস্পরিক একটা যোগসূত্র নির্মিত হওয়া চাই, যেখানে তাঁরা পরস্পর পরস্পরকে বিশ্বাস করেন, ও মানেন। শুধু চিকিৎসক বা রুগী নয়, গোটা চিকিৎসা পরিষেবার পরিমণ্ডলটিকে নিয়ে এখানে বিচার করতে হবে, যে ধরুন য মুহূর্ত থেকে রুগী হাসপাতাল বা চিকিৎসক বা স্বাস্থ্য পরিষেবা-প্রদানকারীর কাছে আসছেন ও যে পর্যন্ত তাঁকে ছেড়ে যাচ্ছেন তার সমগ্র সময়টি ব্যেপে যেন একটি যথাযথ গুণমানের চিকিৎসা পরিষেবা তিনি পেতে পারেন, এইখানে রুগীর বা তাঁর বাড়ির লোকেরও একটি ভূমিকা থেকে যায়। চিকিৎসকের এখানে তাঁর গুণমান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নিজের কাজকর্মের পর্যালোচনা করা, সেখান থেকে শেখার একটি ব্যাপার আছে, এবং সেটি চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকে -- নিজের মূল্যায়ণ করবেন, নিজের ও অন্যান্য প্র্যাকটিস থেকে ধরুন তথ্য গ্রহণ করবেন, তাকে বিশ্লেষণ করবেন, দেখবেন যে কি করে আরো ভাল করে পরিষেবা দিতে পারেন। এটা একদিন কি স্বল্পমেয়াদী ব্যাপার নয়, এতে ক্রমাগত মানোন্নয়নের একটা জায়গা আছে। ডোনাবেডিয়ান বলেন যে ডাক্তারের পক্ষে মানোন্নয়নের একটি উপায় পরস্পরের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে, এক চিকিৎসক অপরকে প্রতিনিয়ত দেখবেন, পরসপর পরস্পরের কাছ থেকে শিখে, যোগাযোগ রক্ষা করে তাঁরা তাঁদের গুণগত মান বাড়াবেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের আদিকাল থেকে এভাবেই চিকিৎসকেরা নিজেদের গুণমান বৃদ্ধি করে এসেছেন ।যে হাসপাতালে হবু ও ট্রেনি ডাক্তারদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত থাকে, বা যেখানে নিয়মিত ভাবে চর্চা করা হয়, সেইসব হাসপাতালে চিকিৎসা-পরিষেবার মানও উন্নত হবে, এটা মোটামুটি ধরে নেওয়া যায়।

রোগী কেন্দ্রিক চিকিৎসা

আমরা এ পর্যন্ত চিকিৎসা-পরিষেবার মানের একটি দিক পর্যালোচনা করেছি, আমরা দেখেছি যে, চিকিৎসা পরিষেবার তিনটি "স্তম্ভ" -- ডাক্তার/চিকিৎসক/পরিষেবা-প্রদায়ী, রুগী, ও যিনি চিকিৎসা পরিষেবায় অর্থ যোগান দেন। ডাক্তার বা যিনি বা যাঁরা অর্থের যোগান দিচ্ছেন (সরকার, বা ধরুন স্বাস্থ্য বীমা কোম্পানী), তাঁদের তরফে স্বাস্থ্য পরিষেবার মান নিয়ন্ত্রণ বা মান নিরূপণের একটি দিক আমরা আলোচনা করেছি। একবিংশ শতকে চিকিৎসক রোগী অর্থদায়ীর নতুন সমীকরণ তৈরী হচ্ছে, তথ্যের ও তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ফোরণ ঘটেছৈ, এবং সেই বিস্ফোরণের ফলে উৎসৃষ্ট তরঙ্গ চিকিৎসা-বিজ্ঞান ও চিকিৎসা পরিষেবা ও চিকিৎসক রোগীর পারস্পরিক সম্বন্ধকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। এখন বিভিন্ন রোগীরা ইন্টারনেটে মিলিত হচ্ছেন, নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করছেন, এমনকি নিজেদের অসুখ নিয়ে গবেষণা অবধি শুরু করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে রোগী-কেন্দ্রিক চিকিৎসা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা ও তাকে প্রাত্যহিক জীবন ও চিকিৎসার গুণমান নির্ণয়ের কেন্দ্রে নিয়ে আসার একটি প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

ডন বারউইকের তিনটি স্লোগান

রোগী কেন্দ্রিক চিকিৎসা পরিষেবার ধারণাটি বহু পুরনো, এবং এ নিয়ে ১৯৬০ এর দশক থেকে নানান চিন্তাভাবনা হয়েছে। ষাটের দশকে মার্কিন সমাজতত্ত্ববিদ জন ওয়ের "জীবনের মান" সংক্রান্ত একটি প্রশ্নমালা তৈরী করেছিলেন, তাতে ৩৬ টি প্রশ্ন ছিল, পরবর্তী কালে এ প্রশ্নমালা আরো নানা ভাষায় অনুদিত হয়েছে, বর্তমানে বিশ্ব-স্বাস্থ্য সংস্থাও অনুরূপ প্রশ্নমালা তৈরী করেছেন। এতে করে রুগীর বা সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের মান নিয়ে একটা স্পষ্ট ধারণা তৈরী হয়, ও চিকিৎসার উপযোগিতার বিভিন্ন গবেষণায় এই ধরণের মান নির্ণয় নিয়ে কাজ হয়েছে। ডাক্তার রুগীর পারস্পরিক সম্বন্ধ ও তাঁদের পারস্পরিক যোগাযোগ নিয়েও বিস্তর গবেষণা হয়েছে। রুগী বা রুগীর পরিপ্রেক্ষিতকে সনাতন চিকিৎসা পরিষেবার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসার কাজে অগ্রগণ্য ভূমিকা রয়েছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশুচিকিৎসক ডোনাল্ড বারউইকের। ডোনাল্ড বারউইক তিনটি স্লোগানের কথা বলেন, যেগুলো বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। একবার দেখা যাক। এক, "রোগীর প্রয়োজনই একমাত্র প্রয়োজন"- সর্বাগ্রে রোগীর প্রয়োজন, কিসে তাঁর ভাল হবে, সেই প্রয়োজনকে চিকিৎসার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা। চিকিৎসা-পরিষেবায় চিকিৎসক মেনে নেবেন যে এযাবৎ "ডাক্তারবাবু যা বলবেন সেটাই শেষ কথা", এই ব্যাপারটিকে উল্টো করে দেখা। ব্যাপারটা কিরকম? রুগীর জীবন দিয়ে বিচার করুন। জীবনকে যদি বেঁচে থাকার উৎসব বলে বিবেচনা করি, তাহলে ডাক্তার আর রুগীর সম্বন্ধ সেখানে কেমন? সাধারণ বুদ্ধি বা অভিজ্ঞতা বলে সে উৎসবের হোতা হলেন চিকিৎসক, তিনি স্থির করবেন রুগীর কি চিকিৎসা হবে, কিভাবে হবে, কি ওষুধ নেবেন, কি খাবার কি পথ্য নেবেন। রুগী এই দৃষ্টিভঙ্গিতে চিকিৎসা নামে কর্মযজ্ঞে নেহাতই একজন অতিথি। বারউইকের রুগী-কেন্দ্রিক চিকিৎসা যখন চিকিৎসা-পরিষেবার মান নির্ণয়ের কেন্দ্রস্থলে, সেখানে ব্যাপারটা অন্যরকম। রুগী সেখানে হোতা, তিনি স্থির করবেন, তাঁর কি চাই, কি তিনি চান। যখন যা তিনি চান, যা তাঁর প্রয়োজন, স্বাস্থ্য পরিষেবা তাঁকে যেন সেই পরিষেবা সুষ্ঠু ভাবে পৌঁছে দিতে পারে। ডাক্তার/চিকিৎসক এখানে অতিথি, রুগী সেই চিকিৎসা ব্যবস্থার হোতা। দুই, ডাক্তার মেনে নেবেন যে, "প্রতিটি রোগীই আমার একমাত্র রোগী"। যেহেতু রুগীর প্রয়োজন কেন্দ্রিক চিকিৎসা, তিনি যা চান তাকে কেন্দ্র করে চিকিৎসা পরিষেবা আবর্তিত হবে, রুগীর ভূমিকাটি এখানে মুখ্য। উদাহরণস্বরূপ ধরুন, চিকিৎসা চলাকালীন রুগীকে রোগ সম্বন্ধে বিশদভাবে ডাক্তার বুঝিয়ে বলবেন, তাঁদের সম্পর্ক একটা সমান্তরাল পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও বিশ্বাসের ওপর স্থির থাকবে। তিন, "আমি রোগী, আমাকে বাদ দিয়ে আমার ব্যাপারে কোনকিছু নয়"। এখানেও সেই এক বক্তব্য, যে রুগীকে বাদ দিয়ে তাঁকে না জানিয়ে তাঁর অনুমতি ব্যতিরেকে যেন কোন রোগ অনুসন্ধান , বা চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন না করা হয়। এতে একদিকে যেমন চিকিৎসাকে রুগীর ব্যক্তিগত পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ে আসা চাই, তেমনি যে চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে তা রুগীর সম্পূর্ণ গোচরে, তার অনুমতি নিয়েও তার আয়োজন করতে হবে। চিকিৎসা পরিষেবায় যেন স্বচ্ছতা থাকে।

উপসংহার - আমার অভিজ্ঞতা - পুনরায়

আমার হাতের ক্ষত ও তার চিকিৎসার কথা বলে শেষ করি। শুরু করেছিলাম একটি প্রশ্ন দিয়ে: অভিজ্ঞ নার্স, যা করা উচিৎ সেভাবেই ড্রেসিং করলেন, আমি ভালও হয়ে গেলাম যথাসময়ে, তবুও কেন চিকিৎসা পরিষেবার কোন জায়গায় খুঁত থেকে গেল? চিকিৎসা হল বটে , তবে সে রোগী-কেন্দ্রিক চিকিৎসা হল কিনা তা নিয়ে তর্কের অবকাশ থেকে যায়। একদিকে তিনি বলবেন, কেন যা করা উচিৎ তাই করা হয়েছে, কিন্তু চিকিৎসার নৈর্বক্তিকতায়, যেটা উহ্য রয়ে গেল সেটি আমার পরিপ্রেক্ষিত। এখন একবিংশ শতাব্দী, চিকিৎসা-বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির যুগে আমার দাঁড়িয়ে। জিন প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা চিকিৎসার "ব্যক্তিকরণ"-এর কথা বলি, কিন্তু চিকিৎসা পরিষেবার "ব্যক্তিকরণের", রোগী কেন্দ্রিক চিকিৎসাকে পরিষেবার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসার একটি যুক্তি রয়েছে। বিশেষত, চিকিৎসা পরিষেবার মান নির্ধারণে।

পরিশিষ্ট